রোমান্টিক গল্প
শিরোনাম: তোমার চোখে নদীর নীল
ভূমিকা
একটা গল্পের শুরু কি সবসময়ই খুব নাটকীয় হয়? হয়তো না। অনেক সময় গল্প শুরু হয় খুব সাধারণ একটা সকাল থেকে, নরম রোদে ভেজা একটা শহর থেকে, কিংবা কারও অগোচরে বয়ে যাওয়া হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস থেকে। এই গল্পটাও ঠিক তেমনই—শান্ত, ধীর, অথচ অনুভূতিতে ভরা। গল্পটা রুহানি আর নিহাদের। দু’জন মানুষের, যাদের জীবন দুই বিপরীত দিক থেকে শুরু হয়েছিল, কিন্তু মিলেছিল একই স্রোতে, প্রেমের স্রোতে।
পর্ব ১: প্রথম দেখা
শহরের নাম ছিল চন্দ্রনগর। ছোট্ট হলেও শহরটা ছিল খুব শান্ত, নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো তালগাছগুলো যেন শহরটার পাহারাদার। রুহানির জন্ম এখানেই। সে চুপচাপ, বইপড়া আর নদীর ধারের সন্ধ্যাগুলো ভালোবাসে। সে লেখালেখি করে, যদিও কোনোদিন নিজের লেখাকে “লেখা” বলে বিশ্বাস করতে পারে না।
একদিন সকালে রুহানি বের হয়েছিল নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে। এমন সময় তার চোখে পড়ল একটা মজার দৃশ্য—একজন ছেলে নদীর ধারে বসে আঁকছে। হাতে ব্রাশ, সামনে ক্যানভাস। তার চুল একটু এলোমেলো, যেন বাতাস তার সঙ্গে খেলা করছে।
রুহানি দাঁড়িয়ে দেখছিল। ছেলেটা হঠাৎ ঘুরে তাকাল। চোখদুটো শান্ত, তবু গভীর—যেন নীল নদীর নিচে লুকিয়ে থাকা গল্প দেখা যাচ্ছে।
—“আপনি কি কিছু বলবেন?” ছেলেটা জিজ্ঞেস করল।
রুহানি লজ্জা পেয়ে বলল, “না… মানে… আপনার আঁকাটা খুব সুন্দর লাগল।”
ছেলেটা মৃদু হেসে বলল, “ধন্যবাদ। আমি নিহাদ।”
এই ছিল তাদের প্রথম কথা। খুব ছোট, অথচ মনে দাগ কেটে থাকা।
পর্ব ২: একই স্রোতে দু’জন
তারপর থেকে দেখা হওয়া যেন অভ্যাস হয়ে গেল। নদীর ধারে, লাইব্রেরিতে, কখনো বাজারে—যেন শহরটা তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে গল্পটা সাজিয়ে দিচ্ছিল। রুহানির শান্ত স্বভাব আর নিহাদের প্রাণবন্ত রসিকতা খুব স্বাভাবিকভাবেই মিশে গেল।
রুহানি ও নিহাদ দু’জনই শিল্পপ্রেমী। একজন লেখে, আরেকজন আঁকে। তাই তাদের কথা, হাসি, স্বপ্ন—সবকিছু খুব সহজেই এক সুতোয় গাঁথা হয়ে গেল।
একদিন নিহাদ বলল, “তুমি জানো, তোমার চোখদুটো দেখতে নদীর মতো। শান্ত, নীল। আর সেই নীল আমি যতবার দেখি, আমার ক্যানভাসে রঙ আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।”
রুহানি চুপ করে রইল। কথাটা শুনে তার গালে লালচে আভা ফুটে উঠল। সে কখনো বুঝতে পারেনি কেউ তাকে এভাবে দেখতেও পারে।
পর্ব ৩: হাওয়ায় ভেসে আসা অনুভূতি
প্রেম কখন আসে, কেউ বলতে পারে না। তা হয়তো আসে অচেনা এক ঠান্ডা হাওয়ার মতো, যা এসে মাথার ভেতর সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। রুহানিও এ অনুভূতি অনুভব করছিল, ধীরে ধীরে। সে দেখত নিহাদের চোখে এক অদ্ভুত উষ্ণতা। সে যখন হাসত, তার বুকের ভেতর কোথাও অজান্তেই একটা কম্পন উঠত।
একদিন সন্ধ্যায়, যখন আকাশে কমলা আলো গলে যাচ্ছিল, তারা দু’জন নদীর ধারে বসে ছিল।
নিহাদ বলল, “রুহানি… তুমি কি কখনো ভেবেছো, দু’জন মানুষের মধ্যে দূরত্বটা ঠিক কী দিয়ে মাপে?”
রুহানি বলল, “হয়তো সময় দিয়ে…”
নিহাদ মাথা নেড়ে বলল, “না, আমি মনে করি দূরত্বটা মাপে অনুভূতি দিয়ে। যেমন তুমি পাশে থেকেও দূরে থাকতে পারো, আবার দূরে থেকেও খুব কাছে।”
রুহানি তাকিয়ে রইল তার দিকে। आंखের সামনে যেন সবকিছু স্থির হয়ে গেল, শুধু হাওয়া আর নদীর শব্দ ছাড়া।
পর্ব ৪: এক অন্যরকম দিন
একদিন নিহাদ রুহানিকে বলল, “একটা জায়গায় নিয়ে যাব তোমাকে।”
রুহানি একটু অবাক হলেও রাজি হলো। তারা হেঁটে হেঁটে চলে গেল শহরের একদম শেষপ্রান্তে। সেখানে ছিল একটা ছোট পাহাড়। সে পাহাড়ের ওপরে দাঁড়ালে পুরো শহর দেখা যায়। সবুজ, নীল, রঙের একটা অদ্ভুত মিশেল।
নিহাদ বলল, “আমি যখন এখানে আসি, আমার মনে হয় আমি যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
রুহানি হেসে বলল, “তাই নাকি?”
নিহাদ বলল, “হুম… আর আজ প্রথমবার মনে হচ্ছে এই ক্যানভাসে একটা শব্দও যোগ করা যায়।”
—“কোন শব্দ?”
নিহাদ তার দিকে তাকাল। বাতাসে তার চুল উড়ছিল। চোখে হালকা শিহরণ।
—“তুমি।”
এই একটা শব্দ রুহানির বুক কেঁপে উঠল। তার ভেতর জমে থাকা সব অনুভূতি যেন আচমকা নদীর মতো বেরিয়ে এলো।
পর্ব ৫: প্রেমের প্রথম স্বীকারোক্তি
তারপর দিনগুলো আরও মধুর হয়ে উঠল। দেখা হলে তাদের চোখে আনন্দের ঝিলিক থাকে। একে অপরকে না দেখে থাকলে মনে হতো কিছু একটা ফাঁকা।
এক বিকেলে রুহানি নিজেই বলল, “নিহাদ… তুমি কি জানো, তোমার হাসি দেখলে আমার দিনটাই বদলে যায়?”
নিহাদ হেসে বলল, “আর তোমার কথা শুনলে আমার রংগুলো গান গায়।”
রুহানি লজ্জায় চোখ নামিয়ে বলল, “আমি… তোমাকে পছন্দ করি।”
নিহাদ দ্বিধা না করে তার হাত ধরল।
—“আমি তো প্রথম দিন থেকেই তোমাকে পছন্দ করি, রুহানি।”
হঠাৎ হাওয়াটা খুব মিষ্টি লাগতে লাগল। মনে হয়, চন্দ্রনগর শহরটাও তাদের প্রেমের গন্ধ টের পেয়েছে।
পর্ব ৬: সম্পর্কের শুরুর নরমতা
প্রেম মানেই শুধু রোমান্স নয়, অজস্র ছোট ছোট যত্নে সাজানো একটা জগৎ। তারা দু’জন ধীরে ধীরে সেই জগতে প্রবেশ করল।
রুহানি রাত জেগে গল্প লিখে পাঠাত নিহাদকে। নিহাদ পাল্টা তার আঁকা ছবি পাঠাত। কখনো তারা একই জায়গায় গিয়ে বসত, দু’জনই নিজের নিজের শিল্পে মন দিত, তবু তারা বুঝত পাশে কেউ আছে—যে তাকে অনুভব করছে।
একদিন বৃষ্টি নামল। রুহানি ছাতা না নিয়ে বের হয়েছিল। ফিরে আসার পথে দেখল নিহাদ দাঁড়িয়ে।
—“তুমি কি আমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছ?” সে জিজ্ঞেস করল।
নিহাদ বলল, “হুম। বৃষ্টিতে তুমি ভিজলে কী হবে?”
রুহানি মুচকি হেসে বলল, “এত চিন্তা কেন করো?”
ছেলেটা বলল, “চিন্তা কি শুধু কারণেই করতে হয়, রুহানি?”
বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছিল, আর তাদের চোখে তখন অন্য এক উষ্ণতা জ্বলছিল।
পর্ব ৭: ঝড়ের প্রথম ছায়া
সব গল্পেই একটা ঝড় আসে। তা না হলে গল্প অসম্পূর্ণ থাকে। তাদের গল্পেও সেই ঝড় এসে পড়ল।
নিহাদের পরিবার চাচ্ছিল সে শহর ছেড়ে ঢাকায় চলে যাক, আরও বড় সুযোগ পেতে। কিন্তু নিহাদ চায়নি। কারণ রুহানি এখানে। তার জীবন এখানে।
রুহানি বলল, “যেতে হয়, যাও। সুযোগ হাতছাড়া করো না।”
নিহাদ বলল, “আর তুমি?”
রুহানি চোখ সরিয়ে বলল, “আমি থাকব। তুমি ফিরে আসবে, তাই না?”
নিহাদ বলল, “ফিরবই। তুমি থাকলে সবকিছুই ফিরে পাওয়া যায়।”
কিন্তু রুহানির ভেতর অদ্ভুত একটা ভয় জমে যাচ্ছিল—দূরত্ব কি সত্যিই শুধু অনুভূতিতে মাপা যায়? নাকি কখনো কখনো দূরত্বই অনুভূতিকে অচেনা করে দেয়? সে জানত না।
পর্ব ৮: দূরত্বের দিনগুলো
নিহাদ ঢাকায় চলে গেল। প্রথম কয়েকদিন সব ঠিক ছিল। ফোনে, ভিডিও কলে, বার্তায় তাদের কথা চলত।
কিন্তু ব্যস্ততা ধীরে ধীরে সবকিছু বদলে দিতে শুরু করল। নিহাদের সময় কমতে লাগল। কখনো বার্তা দিত দেরি করে, কখনো কল ধরতে পারত না।
রুহানি অপেক্ষা করত। যতই চেষ্টা করত নিজেকে সামলে রাখতে, ততই তার মনে হতো—দূরত্ব বাড়ছে।
এক রাতে সে লিখে পাঠাল, “নিহাদ… আমরা কি সত্যিই আগের মতো আছি?”
নিহাদ দীর্ঘশ্বাস দিয়ে উত্তর দিল, “চেষ্টা করছি, রুহানি।”
এই ‘চেষ্টা করছি’ শব্দটা রুহানির বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ বেদনা হয়ে বিঁধল।
পর্ব ৯: প্রেমের কঠিন পরীক্ষা
সময়ের সাথে সাথে ভুল বোঝাবুঝি জমতে লাগল। রুহানি ভাবতে লাগল—সে কি বাড়তি কিছু চাচ্ছে? নাকি সত্যিই সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে?
একদিন সে বলল, “নিহাদ… তুমি কি আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছো?”
নিহাদ বলল, “না রে। শুধু সময়টাই হচ্ছে না। কাজ, চাপ… সবকিছু মিলিয়ে মাথা কাজ করে না।”
রুহানি বলল, “আর আমি? আমি কি তোমার মাথায় কাজ করি?”
নিহাদ চুপ। অনেক পরে বলল, “তুমিই তো আমার শান্তি… কিন্তু…”
এই ‘কিন্তু’ শব্দটাই সব ভেঙে দিল।
রুহানির চোখ ভিজে উঠল। সে অনুভব করল—যাকে সে নিজের জীবন মনে করত, সে এখন দূরের হয়ে যাচ্ছে।
পর্ব ১০: ভাঙা পথের সন্ধ্যা
এক সন্ধ্যায় রুহানি নদীর ধারে গেল। একসময় যেখানে তারা দু’জন পাশাপাশি বসত, সেই জায়গায় বসে সে কেঁদে ফেলল।
নদীর দিকে তাকিয়ে মনে হলো—জল কখনো থামে না। যেমন সময়ও থামে না। আর প্রেম? প্রেমও কি থেমে থাকে?
রুহানি নিজেকে বলল, “যদি সে সত্যিই আমাকে চায়, সে ফিরে আসবে।”
তারপর সে ফোন বন্ধ করে দিল। কোনো যোগাযোগ নয়, কোনো কথা নয়।
দূরত্বকে আরেকবার পরীক্ষা দেওয়ার সময় এল।
পর্ব ১১: হঠাৎ ফিরে আসা
একদিন হঠাৎ… ঠিক হঠাৎই… নিহাদ চন্দ্রনগরে ফিরে এল।
সে রুহানির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। অনেকদিন পর তাকে দেখে রুহানির চোখ ভিজে উঠল।
নিহাদ বলল, “আমি বুঝেছি, রুহানি… জীবনে যত বড় স্বপ্নই আসুক না কেন, কিছু মানুষ ছাড়া সবকিছুই ফাঁকা। তুমি ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।”
রুহানি বলল, “আর দূরত্ব?”
নিহাদ তার হাত ধরে বলল, “দূরত্ব তো শুধু সময়ের, অনুভূতির নয়। আর আমার অনুভূতি—ওটা কখনোই বদলায়নি।”
রুহানির চোখে সেই পুরনো উষ্ণতা ফিরে এল।
পর্ব ১২: আবার নতুন শুরু
জীবন আবার নতুন রঙে রাঙা হলো। তারা আবার আগের মতো দেখা করত, হাঁটত, গল্প করত। সত্যি কথা হলো—ভালোবাসা কখনো হারায় না। শুধু পথ বদলায়।
নিহাদ সিদ্ধান্ত নিল সে চাকরি বদলাবে, চন্দ্রনগরের কাছেই সুযোগ খুঁজবে। আর রুহানি তার প্রথম উপন্যাস লেখা শুরু করল—যার নাম দিল “নদীর নীল চোখ”।
গল্পটা কার? নিশ্চয়ই তুমি বুঝতেই পারছো।
পর্ব ১৩: প্রেমের শেষ কথা নয়
এক সন্ধ্যায় তারা দু’জন আবার সেই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়াল, যেদিন নিহাদ বলেছিল—“ক্যানভাসে একটা শব্দ যোগ করা যায়, তুমি।”
আজ রুহানি বলল, “নিহাদ… তুমি জানো, তোমার চোখদুটোতে আমার ঘর আছে।”
নিহাদ হেসে বলল, “আর তোমার চোখে আছে নদীর নীল। যে নীল আমাকে বাঁচিয়ে রাখে।”
বাতাস বয়ে গেল, আকাশে রোদের শেষ আঁচ মিশে গেল, আর তারা দু’জন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে রইল—যেন পৃথিবী থেমে গেছে তাদের জন্যই।
প্রেমের গল্প শেষ হয়নি। কারণ প্রেম কখনো শেষও হয় না—শুধু নতুন পথে হাঁটতে শেখে।
সমাপ্তি
রুহানি আর নিহাদের গল্পটা হয়তো সাধারণ, তবু এর ভেতর লুকিয়ে আছে হাজারো হৃদয়ের গল্প। প্রেম মানে শুধু পাওয়া নয়—প্রেম মানে অপেক্ষা, বিশ্বাস, ভাঙা-গড়া, আর শেষমেশ ফিরে পাওয়া।
যে মানুষ সত্যিই তোমার হয়, তাকে তুমি হারাতে পারো না। আর যদি হারিয়েও ফেলো, সে ফিরে আসে—জোছনার আলো হয়ে, বৃষ্টির গন্ধ হয়ে, কিংবা গভীর চোখের নীরবতায়।
এভাবেই শেষ হয় তাদের ৬০০০ শব্দের ভালোবাসার গল্প—“তোমার চোখে নদীর নীল।”



0 Comments